নিয়োগ বাণিজ্যে অস্থির দুই বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক-প্রকাশকঃ মারুফুর রহমান মারুফ
শনি, 04.11.2017 - 09:41 PM
Share icon
 সময় ওয়েব ডেস্ক ।। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার নামাপাড়া গ্রামের যুবক হারুন অর রশিদ। তার অভিযোগ, একই উপজেলায় অবস্থিত 'জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে' মাস্টাররোলে চাকরি পেতে আট লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য এ এম এম শামসুর রহমানকে। এই টাকার জোগান দিতে নিজের মূল্যবান দুই কাঠা জমি বিক্রি করতে হয়েছে তাকে। চাকরি পেতে একইভাবে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যকে টাকা দিয়েছেন তার গ্রামের আরও কয়েক যুবক।
ত্রিশালের আরেক যুবক ওমর ফারুখ আখন্দ। তিনি জানান, চাকরি না পেয়ে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের কাছে টাকা ফেরত চাইলেও এখনও ফেরত পাননি। অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে, অধ্যাপক আলী আশরাফ ২০১৪ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে যোগদান করার পর নিয়োগবাণিজ্যের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদে আরও সাত-আটজন এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ৮০ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। উপাচার্য প্রথমে কর্মচারী পদে কিছু লোককে অ্যাডহক (অস্থায়ী ভিত্তিতে) নিয়োগ দিয়ে পরে তাদের স্থায়ী করে নেন। এ এম এম শামসুর রহমান, আলী আশরাফসহ জনবল নিয়োগ নিয়ে বেপরোয়া বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন কমপক্ষে ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এই উপাচার্যদের নিয়োগবাণিজ্যে বিব্রত খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শেষ পর্যন্ত ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বাধ্য হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় দুটির কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় দুটি হলো- ময়মনসিংহের ত্রিশালের 'জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়' এবং কুমিল্লার কোটবাড়ীতে 'কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়'। পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া পর্যন্ত এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, গত ১২ আগস্ট মেয়াদ শেষ হওয়ায় পর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে বিদায় নেন অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম। এর পর থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এক আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার এ এম এম শামসুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পরই তিনি অর্থের বিনিময়ে নিয়োগবাণিজ্য শুরু করেন। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, ট্রেজারার শামসুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভিসির দায়িত্ব পাওয়ার পর বেআইনিভাবে প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করেন। অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার কাজে শিক্ষকদের জড়ানোর চেষ্টাও করছেন তিনি। নাট্যকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রুহুল আমীন জানান, মাস্টাররোলে অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার বিষয়ে তার সহযোগিতা চান ভারপ্রাপ্ত ভিসি শামসুর রহমান। তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। নিয়োগবাণিজ্য নিয়ে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে। এই রেকর্ড সমকালের হাতেও রয়েছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য এই কথোপকথন রেকর্ডের সত্যতাও স্বীকার করেছেন। রেকর্ডে তিনি বলেন, 'যদি কেউ দাবি করে, তাহলে টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। চাকরি যখন দিতে পারলাম না, নে টাকা ফেরত নিয়ে যা, কৃষিকাজ বা একটা কিছু করে খা।' জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান সমকালকে বলেন, 'নিয়োগ নিয়ে কিছু অভিযোগ আসার পর ওই বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত করা হবে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তারা সমকালকে জানান, নিয়োগ নিয়ে সম্প্রতি ঢাকার একটি ও ঢাকার বাইরে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ব্যাপক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন বলে তাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বন্ধের নির্দেশ দিয়ে সেগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিযোগ উঠেছে, মাস্টাররোলে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য এ এম এম শামসুর রহমান গত দুই মাসে প্রায় দেড়শ' জনের কাছ থেকে কোনো প্রকার রাখঢাক না রেখেই মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেছেন। আবার বেতন ছাড়া মাস্টাররোলে কাজ করাচ্ছেন বেশ ক'জনকে। ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়মিত রদবদল করছেন। আবার তার নিয়োগবাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদে মন্তব্য করায় কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন নাট্যকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রুহুল আমীনকে। নোটিশ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ড. হুমায়ুন কবীর। এ ব্যাপারে নাট্যকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রুহুল আমীন সমকালকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আমি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। একজন শিক্ষক হয়ে অন্যায় কাজে সহযোগিতা করতে পারি না, তাই সত্য বলে দিয়েছি।' খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিজেকে রাষ্ট্রপতির ভাঘ্নে পরিচয় দিয়ে এ এম এম শামসুর রহমান এ নিয়োগবাণিজ্য হালাল করার চেষ্টা করছেন। বিষয়টি দৃষ্টিতে আসায় সম্প্রতি বঙ্গভবন থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, 'এ এম এম শামসুর রহমান নামে রাষ্ট্রপতির কোনো ভাঘ্নে নেই।' কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-১) হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক আদেশে, ২৯ অক্টোবর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আলী আশরাফের বিরুদ্ধে নিয়োগবাণিজ্য করার অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদ রয়েছে আর এক মাস। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সমকালকে বলেন, অধ্যাপক আলী আশরাফ উপাচার্য পদে যোগ দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দিয়েছেন আরও সাত-আটজন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ৮০ জনকে বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। প্রথমে কর্মচারী পদে কিছু লোককে অ্যাডহকে (অস্থায়ী ভিত্তিতে) নিয়োগ দিয়ে পরে তাদের স্থায়ী করে নেন উপাচার্য। সূত্র জানায়, বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১৭৫ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদে নিয়োগ পেয়েছেন ৬০ জন। এর মধ্যে অন্তত ২৫ জন উপাচার্যের নিজ বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। চারটি বিভাগে নিয়োগে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। ইংরেজি বিভাগে উপাচার্যের 'পছন্দের' প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞাপনে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে বলে শিক্ষকদের অভিযোগ।
  সূত্রঃ সমকাল
Share icon