শেরপুরে সাফল্য অর্জনকারী নারী শাপলা

সম্পাদক-প্রকাশকঃ মারুফুর রহমান মারুফ
বুধ, 20.12.2017 - 06:42 PM
Share icon

 
 
 
  স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে ধর্মীয় কুসংস্কার আর পর্দা প্রথা ভেদ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসা শেরপুরের অদম্য আরেক নারী সাবিহা জামান শাপলা। শাপলা নামেই সমধিক পরিচিত এ নারী এবার জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে পেয়েছেন তার কাজের স্বীকৃতি। এখন খ্যাতি পেয়েছেন সাফল্যে প্রস্ফুটিত শাপলা হিসেবে।   ৯ ডিসেম্বর আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কার্যক্রমের আওতায় ‘শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী যে নারী’ ক্যাটাগরিতে তার হাতে ওই সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন শেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন। ওই অনুষ্ঠানে অপর ৪ জয়ীতাসহ শাপলাও শুনান তার জীবনের গল্প। সে গল্প নিয়েই শ্যামলবাংলা২৪ডটকম’র বিশেষ প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব ‘অদম্য নারী : শেরপুরে সাফল্যে প্রস্ফুটিত শাপলা’।       শেরপুর সদর উপজেলার চরমোচারিয়া ইউনিয়নের নলবাইদ গ্রামে শিক্ষক পিতা মোঃ সুরুজ্জামানের ঘরে জন্ম নিলেও এলাকাটি প্রচ- ধর্মীয় কু-সংস্কার ও পর্দা প্রথায় আচ্ছন্ন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল হওয়ায় শাপলার জীবনে বেড়ে উঠার পথ ছিল অনেকটাই কঠিন। কিন্তু শিশুকাল থেকেই চঞ্চলতা ও চপলতাসহ জানার ও শেখার কৌতুহল শাপলার সেই কঠিন পথকে ধীরে ধীরে করে তুলেছে সহজ। এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় তিনি নিজে থেকেই নাচের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই তার শেখা নাচ দোলা দেয় সবার মাঝে। পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাওয়া শাপলা এক পর্যায়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শেরপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ভর্তি হন এবং নৃত্য শিল্পী কমল কান্তি পালের সান্নিধ্যে নৃত্যে দীক্ষা নেন। আস্তে আস্তে নানা অনুষ্ঠানে শহরের বিভিন্ন মঞ্চেও নৃত্য করে আরও সবার আরও সবার দৃষ্টি কাড়েন শাপলা। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের কু-সংস্কারের বেড়াজাল তার পেছনে লেগে থাকায় ১৯৯৩ সনে এসএসসি পরীক্ষার মাত্র ২ মাস আগে বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে ব্যবসায়ী স্বামী সাইফুল ইসলামের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় নৃত্যশিল্পী শাপলাকে। এরপরও থেমে থাকেননি শাপলা। ওই বছর এসএসসি পরীক্ষায় সে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। এরপর কলেজে ভর্তি হয়ে তাকে পরিবারের কড়াকড়িতে বোরখা পড়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হলেও নাচের মোহ তিনি কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেননি। বরং কলেজ শিক্ষার্থী হয়েও তিনি শিশু একাডেমি ও পাতাবাহার খেলাঘর আসরের নৃত্যের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ওই অবস্থায় প্রথম সন্তান সাকিব উল ইসলামের জন্ম হলে বেড়ে যায় সংসারের ঝুট-ঝামেলা। এরপরও তিনি ১৯৯৫ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি ও ১৯৯৭ সালে বিএ পাস করেন। স্বামীকে নিয়ে শহরের ভাড়া বাসায় কাটানোর এক পর্যায়ে ১৯৯৭ সালের দিকে শহরের চাপাতলী এলাকায় স্বামীর কেনা এক খ- জায়গায় বসতি গড়ায় তার কর্মকা- চালানো ক্ষেত্রে কিছুটা সহজ হয়ে উঠে। এরপর তার কোলে আসে দ্বিতীয় সন্তান সিফাত উল ইসলাম। ফলে আরেক দফা বেড়ে যায় সংসারের ঝামেলা। ওই সবকিছু মোকাবেলা করেও তিনি ২০০০ সালে এমএ ও ২০০৩ সালে বিএড পাস করেন। স্বামী সাইফুল ইসলাম বিদেশ থেকে ফেরত আসায় এবং উচ্চ শিক্ষা নিয়েও শাপলা কোন উপার্জন করতে না পারায় শাপলা স্বামীর পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেন একটি বিউটি পার্লার প্রতিষ্ঠার। ফলে ২০০৬ সালের দিকে শহরের নিউমার্কেট এলাকায় গড়ে তুলেন প্রিয়াঙ্গন হারবাল বিউটি পার্লার। মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়ে ওই বিউটি পার্লার চালাতে গিয়েও তাকে শুনতে হয় নিন্দুকদের সস্তা সমালোচনাসহ পোহাতে হয় বাড়তি ঝামেলা। কিন্তু হার না মানা শাপলা শক্ত হাতে সেই পার্লার চালিয়ে যাওয়ার কারণে ঘুরে যায় তার সংসার জীবনের চাকা। স্বাবলম্বীতার পথে অগ্রসর হতে থাকে শাপলা। ওই অবস্থায় ২০০৮ সালের দিকে সাংবাদিকতার দিকে পা বাড়ান। নারী হওয়ার কারণে সেটিতেও নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে। এরপর ২০১০ সালের দিকে সাফল্যের আরেক অধ্যায়ে পা রাখেন শাপলা। জেলা সদরের একটি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের মাদ্রাসায় জুটে যায় তার শিক্ষকতার চাকুরি। ইত্যবসরে তিনি আওয়ামী লীগের আদর্শের রাজনীতিসহ শেরপুরের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এরই ফাঁকে ২০১৪ সালে তিনি শেরপুর প্রেসক্লাবের কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৬ সালে প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হন তিনি।   বর্তমানে তিনি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ ও পাতাবাহার খেলাঘর আসরের সহ-সভাপতি, জেলা মানবাধিকার কমিশনের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও শেরপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির একজন নারী উদ্যোক্তা-সদস্য। তিনি শেরপুরের প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবুল কাশেমের পুত্রবধূ হওয়ায় সেই চেতনাকে ধারণ করেই আগামী দিনগুলোর পথ হাঁটতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তার বড় ছেলে সাকিব বর্তমানে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও ছোট ছেলে সিফাত জেএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে। ওদের প্রতি দৃষ্টিসহ সংসারের দায়িত্ব পালনের পরও শিক্ষা ও চাকুরিতে তার অর্জিত সাফল্য তাকে করেছে জয়িতা। জয়তু জয়িতা, জয়তু শাপলা।  
Share icon