শেরপুর শহরের রাস্তায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ
সম্পাদক-প্রকাশকঃ মারুফুর রহমান মারুফ
রবি, 14.01.2018 - 04:12 PM
স্টাফ রিপোর্টার ॥ সড়ক-মহাসড়কে জাতীয় সমস্যা যানজট নিরসনে সরকারের পাশাপাশি নগর-মহানগরে কাজ করছে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু এরপরও উত্তরণ ঘটানো যাচ্ছে না সেই সমস্যা থেকে। সমস্যাটি সীমান্তবর্তী জেলা শহর শেরপুরের ক্ষেত্রেও প্রকট আকার ধারণ করেছে। যানজটের কারণে প্রতিদিন একজন নাগরিকের ১ ঘন্টা সময় অপচয় হলে কেবল শেরপুর শহরের নাগরিকদের কমপক্ষে ৫০ হাজার শ্রমঘন্টার অপচয় হচ্ছে।
এ কারণে শেরপুর এখন জনদুর্ভোগের শহরে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকল পর্যায়ের মানুষ প্রতিনিয়ত অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তার মধ্যে সময়মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছতে না পারা, কর্মস্থলে বিলম্বে পৌঁছা, মুমূর্ষ রোগীকে সঠিক সময়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে না পারা, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি ভিত্তিতে সেবা প্রদানে গাড়িসমূহ সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে না পারাসহ হাজারও সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের সদিচ্ছায় আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাসহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নিয়েও যখন তা নিরসন করা যাচ্ছে না- ঠিক তখন এবার শহরের রাস্তায়-মোড়ে যেকোন ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
১৪ জানুয়ারি রবিবার দুপুরে শেরপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষ রজনীগন্ধায় অনুষ্ঠিত জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সভায় উপস্থিত কমিটির উপদেষ্টা হুইপ আতিউর রহমান আতিক এমপিসহ অন্যান্য সদস্যদের সম্মতিক্রমে ওই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য সচিব, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম শহরে যানজট নিরসনে রাস্তায়-মোড়ে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ব্যবসায়ীদের আবেদনক্রমে জনস্বার্থে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে নাগরিক সমাজসহ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একটি বিশেষ দুর্ভোগের অবসান হবে।
সভার কথোকতা: সরকারদলীয় হুইপ আতিউর রহমান আতিক এমপি জেলায় সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সেইসাথে তিনি শিশু তাহমিদ হত্যা ও মাদকের ভয়াবহতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, শিক্ষক দম্পতির সন্তান শিশু তাহমিদ হাসানের হত্যার ঘটনা সকলের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। যেভাবে ও যে কারণেই ওই হত্যার ঘটনা ঘটুক না কেন, দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে মামলাটি চাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর বিবেচনায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা যেতে পারে মন্তব্য করে তিনি ওই বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ তৎপরতার উপর গুরুত্বারোপ করেন। একইসাথে তিনি জেলায় মাদকের ভয়াবহতা না কমায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তৎপরতা বাড়ানোসহ ওই বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং সীমান্তের গজনী ও মধুটিলা ইকোপার্কের প্রতি বিরূপ প্রভাব যেন না পড়ে সেজন্য সেখানকার ভ্রমণ নির্বিঘ্ন করতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নানা কৌশল নিতেও পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও র্যাবের নজরদারি-টহল বাড়াতেও গুরুত্বারোপ করেন।
জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন তার সমাপণী বক্তব্যে বলেন, শহরের যানজট নিরসনে পৌরসভা ও পুলিশ বিভাগসহ অন্যান্যদের নিয়ে আমাদেরকে আরও কাজ করতে হবে।
তিনি ব্যবসায়ীদের এক আবেদনের বিষয় উত্থাপন করে হুইপ আতিউর রহমান আতিকের সম্মতিক্রমে জেলা শহরের রাস্তায়-মোড়ে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে পৌর পার্ক, শহীদ মিনার ও সরকারি কলেজ মাঠসহ রাস্তা ব্যতীত অন্যান্য জায়গায় সভা-সমাবেশ করা যাবে। তিনি বলেন, পর্যটন এলাকা গজনী ও ইকোপার্কের সৌন্দর্য বাড়াতে কাজ চলছে। সেখানে পর্যটকদের ভ্রমণ নির্বিঘ্ন করতে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও র্যাবের সহায়তা চাওয়া হবে।
স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রক্ষায় ‘পর্যটন জেলা শেরপুর’ বাস্তবায়নে সবার আরও সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়া মাদকের ছড়াছড়ি বন্ধে পুলিশের পাশাপাশি মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের তৎপরতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনে অনুমোদিত দোকানেও নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে বেচা-কেনার ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে। অন্যদিকে শিশু তাহমিদ হত্যা মামলার তদন্তে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের তৎপরতার উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, পুলিশের তরফ থেকে আবেদন পেলে শিশু তাহমিদ হত্যা মামলাটি লোমহর্ষক, স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করা হবে এবং তদন্ত শেষে প্রয়োজনে তা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট চন্দন কুমার পাল পিপি বলেন, সীমান্তের গজনী ও মধুটিরা ইকোপার্ক শেরপুরের স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে এসেছে, যা এখন ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কাড়ছে। কিন্তু সেই পর্যটন স্পট দু’টিতে নির্বিঘ্নে ভ্রমণের অবস্থা নেই। এছাড়া জেলায় মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের তেমন কোনো তৎপরতা না থাকায় মাদকে সয়লাব হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বর্তমানে ইয়াবার ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এর উৎস খুজে বের করাসহ গডফাদারদেরকে শনাক্ত করতে হবে। এছাড়া শহরের অনুমোদিত একটি মদের দোকানে বর্তমানে নিম্নমানের ও ভেজাল মদ বিক্রি হচ্ছে। নিয়ম-নীতিকে তোয়াক্কা না করে যাচ্ছেতাইভাবে চলছে সেই দোকানটি। এখানেও মাদক বিভাগের লোকজনের কোন নজর নেই।
শেরপুর পৌরসভার মেয়র গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া লিটন শহরের যানজট সমস্যা প্রসঙ্গে বলেন, পৌর এলাকায় ১৫শ অটোরিক্সার লাইসেন্স দেওয়ার অনুমতি থাকলেও দেওয়া হয়েছে ১২শ। কিন্তু শহরের বাইরে থেকে সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নসহ অন্যান্য উপজেলা থেকে পর্যন্ত অটোরিক্সা জেলা শহরে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে আবার রয়েছে প্রায় ৩০ ভাগ যান্ত্রিক রিক্সা, যেগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি সদরের ইউনিয়নগুলোসহ অন্যান্য থানার অটোরিক্সা শহরে প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ, প্রধানতম মোড় খোয়ারপাড়সহ বিভিন্ন মোড়ে পুলিশের অভিযান পরিচালনা ও পৌরসভার অভিযানে সহায়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) খন্দকার খালিদ বিন নূর বলেন, শেরপুর মূলতঃ একটি শান্তিপ্রিয় এলাকা। এখানে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল রয়েছে।
আশা করি সকলের সহযোগিতায় আইন-শৃঙ্খলার দিক থেকে শেরপুরকে আরও ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তিনি শীত মৌসুমে কুয়াশায় দুর্ঘটনারোধে রোড মার্কিং থাকার উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, পর্যটন এলাকা গজনী ও ইকোপার্কে পুলিশের পাশাপাশি তৎপরতা বাড়াতে বিজিবি ও র্যাবের সহায়তা চাওয়া হবে।
প্রেসক্লাব সভাপতি রফিকুল ইসলাম আধার এবার ডিসি উদ্যানে আয়োজিত ৩ দিনব্যাপী উন্নয়ন মেলা এবং পুলিশের ৭দিনব্যাপী বিশেষ অভিযান সফল হওয়ায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, শহরে শিক্ষক দম্পতির সন্তান তাহমিদ হত্যার ঘটনায় শিক্ষক সমাজসহ নাগরিক বিবেক নাড়া দিয়ে উঠেছে। এ লোমহর্ষক ঘটনায় দ্রুত যথাযথ তদন্ত, রহস্য উদঘাটনসহ জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
এক্ষেত্রে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিশেষ নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া মাদকের ভয়াল থাবা থেকে যুব সমাজকে রক্ষায় মাদক অধিদপ্তরের তৎপরতা বাড়ানোসহ অন্যান্যদের আরও সক্রিয় হয়ে কাজ করতে হবে।
জেলা প্রশাসক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আরিফুল ইসলাম, শেরপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. একেএম রিয়াজুল হাসান, জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরু, নকলা উপজেলা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সারোয়ার হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব সরকার, কাস্টমস’র সহকারী পরিচালক আব্দুল হান্নান, অধ্যক্ষ শহীদুল ইসলাম মুকুল, নকলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জিন্নাহ, সাংবাদিক দেবাশীষ ভট্টাচার্য, শহর কমিউনিটি পুলিশের সাধারণ সম্পাদক কাজী মতিউর রহমান মতি প্রমুখ। সভায় পৌর মেয়র, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণসহ কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।