স্মার্ট ফোনের যুগেও শিশু-কিশোরদের মাঝে কাগজের বইয়ের কদর বাড়ছে শেরপুরে
স্মার্ট ফোনের যুগেও কাগজের বইয়ের প্রতি শিশু-কিশোর ও তরুন সমাজের আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। কথাটা শুনলে হয়তো অনেকইে হেসে উড়িয়ে দিবে। কিন্তু এর বাস্তবতা চোখে পড়েছে শেরপুরে। শেরপুরে ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী এর জলন্ত প্রমাণ। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের বাস্তবায়নে গণগন্থাগার অধিদপ্তরের দেশ ব্যাপী ভ্রম্যমান লাইব্রেরী প্রকল্পের আওতায় জেলায় একটি ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী গত ২০১৯ সালের জুন মাস থেকে পাঠক সেবা দিয়ে আসছে। এ লাইব্রেরী বর্তমানে জেলা সদরসহ ৫ উপজেলায় ৪৭ টি স্পটে বই পড়ার সেবা দিয়ে আসছে।
ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী সূত্রে জানাগেছে, প্রতি মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া বাকী ৬ দিন রুটিন অনুযায়ী জেলার ৪৭ টি স্থানে এ লাইব্রেরী দিন ব্যাপী বই পাঠের জন্য সেবা দিয়ে আসছে। এ লাইব্রেরী প্রতি শুক্রবার, সোম ও বুধবার শেরপুর সদর উপজেলা, শনিবার নালিতাবাড়ি উপজেলা সদর ও তিনআনী বাজার এলাকা, রবিবার নকলা উপজেলা এবং বৃহস্পতিবার ঝিনাইগাতি ও শ্রীবর্দী উপজেলায় ভ্রমন করেন।
লাইব্রেরীতে ৪ ধরনের সদস্য রয়েছে এর মধ্যে সাধারণ, বিশেষ, অগ্রবর্তী ও বিশেষ অগ্রবর্তী সদস্য। সাধারণ সদস্য হতে এক বছরের জন্য ১০০ টাকা ফেরত যোগ্য জামানতসহ ও প্রতি মাসের ফি বাবদ ১০ টাকা হারে ৬ মাসের ৬০ টাকা সহ মোট ১৬০ টাকা, বিশেষ সদস্যের জন্য ২০০ টাকা ফেরত যোগ্য জামানতসহ প্রতি মাসের ফি বাবদ ১০ টাকা হারে ৬ মাসের ৬০ টাকাসহ মোট ২৬০ টাকা, অগ্রবর্তী সদস্য হতে ৫০০ টাকার ফেরত যোগ্য জামানাতের সাথে ৬ মাসের ১০ টাকা হারে মোট ৫৬০ টাকা এবং বিশেষ অগ্রবর্তী সদস্য হতে ৮০০ টাকার ফেরত যোগ্য জামানাতের সাথে ৬ মাসের ৬০ টাকাসহ মোট ৮৬০ টাকা প্রদান করে নির্ধারিত ফরম ফিলাপ করে সদস্য হতে হয়।
এরপর সদস্যদের নিজ নিজ পছন্দের বই প্রথমে ৭ দিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। পরবর্তি সপ্তাহে পূর্বের বই ফেরত দিয়ে আবার নতুন করে বই নেয়া যায়। তবে কেউ যদি এক সপ্তাহে কোন বই পড়ে শেষ করতে না পারে তবে তা পুনরাই অনুমতি নিয়ে আরো কয়দিন সময় নেওয়া সুযোগ রয়েছে।
করোনার কারণে দীর্ঘ দিন এ ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীর কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর গত বছরের নভেম্বর থেকে পুনরাই চালু হয়েছে। সর্ব শেষ জরিপে দেখা গেছে গত ৬ মাস পূর্বে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে এ লাইব্রেরীর পাঠক সংখ্যা ১ হাজার ১০৯ জন ছিলো এবং বর্তমান চলতি মাসে পাঠক সংখ্যা হয়েছে ১ হাজার ৪০৯ জন। প্রতি মাসেই পাঠক সংখ্যা গড়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন করে বাড়ছে। এ লাইব্রেরীতে রয়েছে ভ্রমণ কাহিনী, রূপকথা, ভৌতিক, অনুবাদ, বিদেশী গল্প, দেশীয় গল্প, উপন্যাস, ছাড়া-কবিতা, শিশুতোষ বইসহ বিভিন্ন রকমের বই। এখানে সদস্যদের মধ্যে প্রায় সবাই স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। তবে কিছু রয়েছে একেবারেই শিশু এবং বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা ও বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
পাঠক সেবা ছাড়াও এ লাইব্রেরীর আয়োজনে প্রতি মাসে বিভিন্ন স্থানে কবিতা পাঠ, চিত্রাংকন, রচনা প্রতিযোগীতা, গ্রন্থ পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এসময় বিজয়ী ও সেরাদের পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয় বই। এ জন্য ১২ টি সাংস্কৃতিক সংঘ গঠন করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে অনলাই প্রতিযোগীতা। এ প্রতিযোগীতায় বিজয়ীরা পুস্কার হিসেবে পচ্ছে বিভিন্ন রকমের বই। এসব প্রতিযোগীতার পাশপাশি বিভিন্ন সময় সদস্যদের নিয়ে করা হয় সাহিত্য ও গানের আড্ডা।
ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীর সদস্য শিক্ষার্থী তাসফিয়া নারজিস ফাইজা, আহমেদ আরিয়ান, আবরার মুহতাসিন, তৌসিফ আহনাদ, মাহফিয়া বিনতে হাসান, মরিয়ম আক্তার মীম জানায়, তাদের বাসায় মা-বাবা প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয় না। এছাড়া বেশিক্ষণ বই পড়লে মাথা ব্যাথা ও চোখের সমস্যা হয়। তাই এই কাগজের বই পড়তে তাদের ভালো লাগে এবং এই বই পড়তেই তারা অভ্যস্থ হয়েছে। পাঠ্য বই পড়ার ফাঁকে অবসরে তারা তাদের পছন্দের বই পড়ে থাকে। সাত দিনের জন্য বইগুলো রেখে পরে আবার সাত দিন পর বইগুলো ফেরত দিয়ে আবার নতুন বই সংগ্রহ করে।
এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক শহরের নারায়নপুর মহল্লার ব্যাংক কর্মকর্তা মো. জুয়েল জানায়, এই স্মাট ফোনের যুগে ছেলে-মেয়েদের নেতিবাচক প্রভাবের হাত থেকে বাঁচাতে আমাদের অভিভবকদের ঘর থেকেই প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। সেজন্য স্মার্ট ফোনের বদলে কাগজের বইয়ের প্রতি মনযোগী হতে হবে। এতে চোখ ও ব্রেইনের সমস্যা থেকে বাঁচবে এবং প্রকৃত জ্ঞান অর্জনেও লাভবান হবে। তাই আমি আমার ছেলে-মেয়েদের কাগজের বই পড়ার প্রতি জোড় দিয়েছি।
সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক রীতা রাণী সাহা জানায়, আমি মূলত বাড়িতে ছেলে মেয়েদেরকে মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখার জন্য এবং নিজের জন্য পছন্দের বই পড়ার জন্যই এখানে সদস্য হয়েছি। কারণ পাঠাগার বা কোন লাইব্রেরীতের গিয়ে বই সংগ্রহ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এই ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীর আমার জন্য বই পেতে সহজ উপায়। কারাণ তারা আমাদের ঘরের দোয়ারে এসে বই দিয়ে যাচ্ছে। আর আমার ছেলে-মেয়েরাও এখন এই বইয়ের প্রতি অভ্যস্থ হচ্ছে।
শেরপুর সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পায়েল মুরাদ জানায়, ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীর কারণে স্কুল ও কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরা হাতের কাছে বই পেয়ে খুবই উপকৃত হচ্ছে। তাদের এ আয়োজন আমার কাছে আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছে। এছাড়া তারা বিভিন্ন সময়ে অনলাইন প্রতিযোগীতা করার কারণে ছেলে-মেয়েরা বেশ আনন্দের সাথে, উৎসাহের সাথে বই নিয়ে পড়ছে। এই লাইব্রেরীর কারণে যাদের মাঝে বই পড়ার প্রবনতা কম ছিলো তারা আস্তে আস্তে স্মার্ট ফোন রেখেও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ হয়ে উঠছে। যা কী না আমাদের জন্য একটি সুখবরও বটে।
ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীর কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল আলম জানায়, ২০১৯ এর জুলাই মাস থেকে ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীর শেরপুর ইউনিট কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবদেরকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ স্মৃষ্টি করাই আমাদের মূল লক্ষ্য এবং এ থেকেই একজন আলোকিত মানুষ হবে এ প্রত্যাশাও আমাদের। ইতিমধ্যে জেলার ৪৭ টি স্পটে দিন দিন গ্রাহক ও পাঠক সংখ্যা বেড়েই চলছে।
এবিষয়ে জেলা সরকারী গণগ্রন্থাগারের লাইব্রেরীয়ান সাজ্জাদুল করিম জানায়, শিশু-কিশোরদের বই পাঠে আগ্রহী করতে সৃজনশীল বই পাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করা ও তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত বই পড়ার গুরুত্ব ও উপকারীতা সম্পর্কে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উৎসাহ যোগানো। বই পড়া কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসন, শিক্ষা অফিস ও গণগ্রন্থাগারের সম্মিলিত প্রয়াসে নিয়মিত বই পড়া কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হলে আগামী প্রজন্ম কাগজের বই পড়ার প্রতি আরো উৎসাহিত হবে বলে আমি মনে করি।