করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা ও চিকিৎসা পদ্ধতি-ডা. নুরুন্নাহার ফাতেমা
ডা. নুরুন্নাহার ফাতেমাঃ করোনাভাইরাস ডিজিজ-২০১৯ কে সংক্ষেপে কোভিড-১৯ বলা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নভেল করোনাভাইরাস নামে একটি রোগজীবাণু চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এটি পুরো বিশ্বে প্যানডেমিক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য আমি এই রোগ সংক্রান্ত কিছু তথ্য এই লেখার মাধ্যমে জানানোর চেষ্টা করব। প্রথমেই আসে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কীভাবে চিনব এবং তাদের সংস্পর্শে আসা মানুষদের কীভাবে সংজ্ঞায়িত করব। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংজ্ঞা তিন রকম
১. সন্দেহযুক্ত রোগী।
২. সম্ভাব্য রোগী।
৩. নিশ্চিত রোগী।
১.সন্দেহযুক্ত রোগী তিন প্রকারের হতে পারে।
ক) সর্দি-কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট+ যেখানে এই রোগ ইপিডেমিক আকারে দেখা দিয়েছে সেখানে ভ্রমণের ইতিহাস অথবা বসবাস করার ইতিহাস থাকলে। এটি হতে হবে লক্ষণ প্রকাশের ১৪ দিন আগ পর্যন্ত।
খ) কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া+কোনো সংক্রমিত অথবা সম্ভাব্য রোগীর সংস্পর্শে গেলে। এই রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার ১৪ দিন আগে পর্যন্ত এই সংস্পর্শে যাওয়া হতে পারে।
গ) জ্বর, সর্দি-কাশি, প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট+কিন্তু অন্য কোনো রোগ শনাক্ত করা যাচ্ছে না সেই ক্ষেত্রে।
২. সম্ভাব্য রোগীর লক্ষণ দুই রকমের হতে পারে।
ক) সন্দেহযুক্ত রোগী যার টেস্টের রেজাল্ট সন্দেহযুক্ত
খ) সন্দেহযুক্ত রোগী যার কোনো কারণে টেস্ট করানো যাচ্ছে না।
৩. নিশ্চিত রোগী তিনি যার আরটি পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে পজেটিভ শনাক্ত করা হয়েছে।
রোগী শনাক্ত করার পরে আমাদের দায়িত্ব পড়ে তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করার। এদের মাধ্যমে পরবর্তীতে এই রোগ জীবাণু অন্য সুস্থ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কন্টাক্ট বা সংস্পর্শ বলতে বোঝায় কোনো সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বা শিশু যদি কোনো নিশ্চিত বা সম্ভাব্য রোগীর সংস্পর্শে আসে। সংস্পর্শের সময়কাল হচ্ছে ওই সম্ভাব্য বা নিশ্চিত রোগীর রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার দুদিন আগে থেকে ১৪ দিন পর পর্যন্ত। এছাড়াও যারা রোগীর সরাসরি পরিচর্যা করবে তারাও কন্টাক্ট হিসেবে গণ্য হবে। এর মধ্যে ডাক্তার নার্স অন্যান্য চিকিৎসাকর্মী এবং টেকনোলজিস্ট রয়েছেন।
কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত রোগীদের চার ধরনের গ্রুপে ভাগ করা যেতে পারে।
ক) ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো লক্ষণ যা রোগের প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
খ) মাঝারি লক্ষণ যখন রোগীর নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেবে। শরীরে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট হবে।
গ) ভয়াবহ লক্ষণ যখন মারাত্মক নিউমোনিয়া দেখা দেবে এবং প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হবে।
ঘ) চূড়ান্ত লক্ষণ যখন রোগী মুমূর্ষ অবস্থায় পৌঁছে যাবে এবং এবং কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাস যন্ত্রের প্রয়োজন হবে।
রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা লাগবে না। রোগী ফিভার ক্লিনিক বা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে এবং বাড়িতে আইসোলেশনে থাকবে। হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ড বা কেবিনেও ভর্তি করা যেতে পারে।
রোগী দ্বিতীয় পর্যায় বা "নিউমোনিয়া " হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ওয়ার্ডে চিকিৎসা পাবে এবং আইসোলেশনে থাকবে। রোগের তৃতীয় পর্যায় বা "ভয়াবহ নিউমোনিয়া"তে অথবা "সেপসিস "আক্রান্ত হলে রোগী হাই ডিপেন্ডেন্সি ওয়ার্ডে চিকিৎসা পাবে।
রোগের চূড়ান্ত পর্যায় হলো এআরডিএস 'এবং "সেপটিক শক"। এ পর্যায়ে পৌঁছে গেলে রোগীকে অবশ্যই আইসিইউতে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে এবং কৃত্রিম শ্বাস যন্ত্রের প্রয়োজন হতে পারে।
কোভিড-১৯ রোগ শনাক্ত করার জন্য কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হবে।
ক) ভাইরাস শনাক্তকরণ: পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসটি শনাক্ত করা যায়। এক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে নাক, গলা, শ্বাসনালী ইত্যাদির তরল প্রলেপ থেকে।
খ) আরটি পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসের নিউক্লিক এসিড শনাক্তকরণ।
গ) সিটিস্ক্যান চেস্ট (এইচআরসিটি)
ঘ) চেস্ট এক্সরে
ঙ) পিওসিইউএস [পয়েন্ট অব কেয়ার আল্ট্রাসাউন্ড]
চ) সিবিসি lymphopenia leukopenia leukocytosis thrombocytopenia এগুলো পাওয়া যেতে পারে।
ছ) অ্যাবসুলেট লিমফোসাইট কাউন্ট কমে যেতে পারে।
জ) সিআরপি বেড়ে যেতে পারে।
ঝ) প্রোক্যালটোনিন স্বাভাবিক থাকবে।
ঞ) ডি ডাইমার রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে বেড়ে যেতে পারে।
এবিজি অ্যানালাইসিস করে মুমূর্ষু রোগীদের সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে ইন্টারলিউকিন নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয় এবং রোগী তখন মুমূর্ষ অবস্থায় পৌঁছে যায়। এই পর্যায়ে অনেক রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এখানে উল্লেখ্য, এই পর্যায়ে উপনীত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভালো আইসিইউ, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস মেশিন, অ্যানেসথেসিয়লজিস্ট, অভিজ্ঞ ইনটেন্সিভিস্ট এবং পালমোনোলজিস্টের প্রয়োজন। এছাড়াও মেডিসিন এবং শিশু বিশেষজ্ঞগণ বয়সভেদে এই সমস্ত রোগীদের চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।
চূড়ান্ত পর্যায়ে এ সমস্ত রোগীদের চিকিৎসা করা সকল ডাক্তারের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং প্রতিটি করোনা হাসপাতালে উপরোক্ত চিকিৎসকদের নিয়োগ দিয়ে রোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো রোগী সর্দি, কাশি বা জ্বরে আক্রান্ত হলে ধরে নিতে হবে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন যতক্ষণ না পর্যন্ত টেস্টের মাধ্যমে সেটা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এই অবস্থায় রোগীদের দরকার একটি নির্দেশিকা যার মাধ্যমে সে বুঝতে পারবে তার কী করা দরকার। এই নির্দেশিকা গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এবং টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের দারা সবার মধ্যে প্রচার করতে হবে।
সরকারকে উপজেলা পর্যায় থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত ফিভার ক্লিনিক স্থাপন করতে হবে এবং ঘোষণার মাধ্যমে তা সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে। কোন এলাকার রোগী কোন ফিভার ক্লিনিকে যাবে তা সেই এলাকার রোগী এবং ডাক্তারকে জানতে হবে। কোন এলাকার রোগী কোন পরীক্ষাগারে তার টেস্ট করবে তা ডাক্তার এবং রোগী উভয়কেই জানতে হবে।
ক) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, বিভাগীয় হাসপাতালের নির্ধারিত জায়গায় ফিভার ক্লিনিক স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি সর্দি, জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগী প্রথমেই ফিভার ক্লিনিকে এসে ডাক্তার দেখাবে। ফিভার ক্লিনিক কোথায় অবস্থিত তার দিকনির্দেশনা প্রধান গেট থেকে নির্দেশিত থাকবে।
খ) কর্মরত প্রতিটি ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মী থাকবে সুরক্ষিত। তারা প্রতিটি রোগীকে নিশ্চিত রোগী, সম্ভাব্য রোগী এবং সন্দেহযুক্ত রোগী এই তিন ভাগে ভাগ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। সরকার নির্ধারিত উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় এবং রাজধানীর বিভিন্ন চিহ্নিত হাসপাতাল এই সমস্ত রোগীদের প্রয়োজনে ভর্তি করা হবে।
গ) ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো লক্ষণযুক্ত রোগীরা আইসোলেশনে থাকবে। তাদের তেমন কোনো বড় চিকিৎসা লাগবে না।
ঘ) নিউমোনিয়ার লক্ষণযুক্ত রোগীরা ওয়ার্ডে ভর্তি হবে এবং নিয়মিত চিকিৎসা পাবে।
ঙ) মারাত্মক নিউমোনিয়া ও সেপসিস আক্রান্ত রোগীরা এইচডিইউতে উচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসা পাবে।
চ) এআরডিএস এবং সেপটিক শক আক্রান্ত রোগীরা অনতিবিলম্বে আইসিইউতে স্থানান্তর হবে।
সুতরাং এখানে সহজেই অনুমেয় যে প্রতিটি করোনা হাসপাতলে অবশ্যই ওয়ার্ড, এইচডিইউ এবং আইসিইউ থাকতে হবে। প্রতিটি ফিভার ক্লিনিক এবং করোনা হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, টেকনোলজিস্ট সার্বক্ষণিকভাবে পিপিই পরিধান করবে।
উপরোক্ত নিয়ম অনুসরণ করলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত যেকোনো রোগী যেখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করে সময় নষ্ট না করে উপযুক্ত জায়গায় পৌঁছে যেতে পারবে এবং দ্রুত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত হবে। এতে করে অন্যদের মধ্যে রোগ সংক্রমণ ও কম হবে।
বর্তমানে সরকার কিছু অপ্রচলিত হাসপাতালকে করোনা হাসপাতালে রূপান্তর করেছে। এই সমস্ত হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ার করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই প্রতিষ্ঠিত কোনো ভালো হাসপাতালকে করোনা হাসপাতালে রূপান্তর করলে রোগীর ভালো চিকিৎসা নিশ্চিত হবে এবং মৃত্যুর হার কমানো যাবে। সেক্ষেত্রে ওই হাসপাতালে অন্যান্য রোগীকে অন্য হাসপাতালে শিফট করতে হবে।
এই রোগের চিকিৎসার জন্য সরকার জাতীয় নীতিমালা তৈরি করেছে। আমাদের প্রত্যেকের উচিত জাতীয় নীতিমালা অনুসরণ করা।
লেখিকা :স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ও অধ্যাপক, সিএমএইচ, শিশু ও শিশু হৃদরোগ বিভাগ।