শেরপুরে ভুয়া কাজীর দৌরাত্ম্যে বৃদ্ধি পেয়েছে বাল্যবিবাহ

স্টাফ রিপোর্টার
বৃহস্পতি, 20.01.2022 - 05:00 PM
Share icon
Image

১৪ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষার্থী মনিকা (ছদ্দনাম)। দরিদ্র পরিবারের এই মেয়ে স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ালেখা করতো। বিয়ের কয়েকমাস যেতে না যেতেই গর্ভ ধারন করলো। সেই বিয়ের নিবন্ধন করলো স্থানীয় এক ভূয়া কাজী। মেহেদী রং না মুছতেই স্বামী ও তার পরিবারের নির্যাতনে বরণ করতে হলো মৃত্যু। অন্যদিকে ১৩ বছর বয়সী শান্তার (ছদ্দনাম) বিয়ে হয় পার্শবর্তী গ্রামে। সংসারের দ্বায়িত্ব কর্তব্য সঠিক ভাবে না বুঝায় সৃষ্টি হলো পারিবারিক কলহ। অবশেষে বিবাহ বিচ্ছেদ। এখানেও সেই ভূয়া কাজীর নিবন্ধন। আইনের আশ্রয়ের জন্য কাবিন নামা না পেয়ে করতে হলো নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা। ঘটনা গুলো শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়াকাজীরচর ইউনিয়নের।

এমনি ঘটনার অনুসন্ধানে গেলে অভিযোগ ওঠে ভুয়া কাজীদের নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির। এলাকাটিতে ক্রমেই বাড়ছে ভূয়া কাজীদের অপতৎপরতা। বাড়ছে বাল্য বিয়ের সংখ্যা। তথ্যমতে গত এক বছরে ওই ইউনিয়নে সংঘটিত হয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক বাল্য বিয়ের। এদের মধ্যে কেউ হয়েছে তালাকের শিকার, কেউবা রয়েছে ঘর ভাঙ্গার আতংকে। নিকাহ রেজিষ্টার বিধি উপেক্ষিত ভূয়া কাজীর খপ্পড়ে পড়ে রেহাই পাচ্ছে না শিশুসহ প্রাপ্তবয়স্করাও। এতে মেঘে ঢাকা পড়ছে কোমলমতি শিশুদের ভাগ্য। এ বিষয়ে জেলা রেজিষ্টারের নিকট অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগিরা। ফলে দিন দিন বাড়ছে স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার সংখ্যা। সরেজমিন গেলে ভুক্তভোগী, অভিযোগকারী, স্থানীয় সচেতন মানুষসহ প্রশাসনের সাথে কথা বলে ওঠে আসে এমন তথ্য।

উপজেলা প্রশাসন বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করলেও এলাকার সচেতন ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও কতিপয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশেই হচ্ছে এসব বিয়ের ঘটনা। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীরা এসব বিবাহের শিকার হচ্ছে। ফলে এসব নাবালিকা মেয়েরাই অল্প বয়সে সন্তান ধারণ করে নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যায়। অন্যদিকে, কয়েক বছর সংসার করার পর মেয়েরা নানাভাবে মানসিক, শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।

ঘটনা অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়া কাজিরচর উইনিয়নের তৎকালীন কাজী আব্দুল ওয়াহাবের অবসরজনিত কারণে ইউনিয়নে নিকাহ রেজিষ্ট্রার পদ শূন্য হয়। রেজিষ্ট্রারের খামখেয়ালীপনায় ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত দীর্ঘ দুই বছরের অধিক সময়ে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি নতুন নিকাহ রেজিষ্ট্রার নিয়োগের ব্যাপারে। পরে বিষয়টি আলোচনায় আসলেও আইনের তোয়াক্কা না করে সন্নিকটবর্তী ইউনিয়নের কোন কাজীকে দায়িত্ব না দিয়ে দূরবর্তী গোসাইপুর ইউনিয়নের নিকাহ রেজিষ্ট্রার বাদশা আলীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হয়। অন্যদিকে আইন অনুযায়ী ১২০ দিনের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করে নতুন নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের বিধানও কার্যকর করা যাচ্ছেনা মামলা জনিত কারনে।

অপরদিকে অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজীর বাড়ি দূরবর্তী হওয়ায় অবৈধভাবে অতিরিক্ত ৫/৬ জন সহকারি কাজী নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে নিকাহ রেজিষ্টি করছেন এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, খরিয়া কাজিরচর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে মো. সোহাগ রানা, মো.স্বপন মিয়া, মো. সাইফুল ইসলাম, মামুন মিয়া, মো. আসাদুজ্জামান পাপুল, মৌলভী মো. মোতালেব, আব্দুল ওয়াহাব ও নাসির উদ্দিনের নাম উঠে আসে। তারা মধ্য লঙ্গর পাড়া, রুপারপাড়া, দক্ষিণ খড়িয়া, উত্তর খড়িয়া, কাজিরচর, খামারপাড়া এলাকাগুলো আলাদা আলাদা নিয়ন্ত্রণ করেন।

২০১৯ সালে তৎকালিন শেরপুরের জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব শেরপুর জেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষনা করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ নেন। তথাপিও বাল্যবিবাহের পরিমাণ আশাতীত হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। গত বছরে ইউনিয়নের লংগরপাড়া দাখিল মাদ্রাসা, খড়িয়াকাজীর চর উচ্চ বিদ্যালয়,পার্শবর্তী ইউনিয়নের ঝিনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়,হালগড়া রাহেলা মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় সহ একাধিক স্কুলের ৬ষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহের অভিযোগ রয়েছে এই চক্রটির বিরুদ্ধে।

অর্ধশতাধিক বাল্য বিবাহ নিবন্ধনের বিরুদ্ধে শাহীনুল বারী নামের স্থানীয় এক মাদ্রাসা শিক্ষক বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। তিনি এই প্রতিনিধিকে বলেন, অভিযুক্ত কাজী শ্রীবরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক, প্রচুর টাকার মালিক ও প্রভাবশালী। এর জন্য প্রকাশ্যে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়না। যদি কেও প্রতিবাদ করে তবে স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার নামে হুমকি দেয়।

বাল্য বিয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেন লংগড়পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হারুন আল রশিদ। তিনি বলেন, এভাবে বাল্য বিয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলে স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রী ঝড়ে পড়ার সংখ্যাও বাড়বে। বাড়বে নারী নির্যাতন, সংকট তৈরি হবে নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে, বিয়ের জন্য ছেলে পক্ষের অভিভাবক সেজে ভুয়া কাজী মৌলভী মো. মোতালেব, পাপুরসহ কয়েকজনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা তাদের পছন্দের স্থানে ছেলে মেয়েসহ যাওয়ার জন্য বলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্বীকারও করেন।

তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে অতিরিক্ত দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত গোসাইপুর ইউনিয়নের কাজী মো. বাদশা আলীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এমন অভিযোগ আমি পেয়েছি এবং তাদের কয়েকজনকে আমি নিষেধও করেছি। অতিরিক্ত সাব-কাজী নিয়োগের ব্যাপারে তিনি অস্বীকার করে বলেন, আমি কোন সহকারী কাজী নিয়োগ করিনি। শতাধিক বাল্য বিবাহের ব্যাপারে বলেন, আমি কোন বাল্য বিবাহ রেজিস্ট্রি করিনি, কে বা কাহারা এই কাজ গুলো করেছে তা আমার জানা নাই।

অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে শেরপুর জেলা রেজিস্টার হেলাল উদ্দিন বলেন, আমার নিবন্ধিত কাজীর রেজিস্টারের তথ্যের বাইরে কোন বিবাহ নিবন্ধন হলে আমি আমার কাজীদের কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবো না। তবে ভূয়া কাজীর ব্যাপারে অভিযোগ পেয়েছি। তবে আমি প্রমাণ ছাড়া কিছুই করতে পারবো না।

সরেজমিন তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে প্রশাসন। এমনটাই মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দা সহ সচেতন মানুষেরা।

Share icon