শেরপুরে বিনা নোটিশে কৃষি জমিতে খাল খনন
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী তাড়ানি এলাকায় বিনা নোটিশ ও ক্ষতিপূরণ ছাড়াই কৃষি জমির ফসল নষ্ট করে খাল খনন করা হচ্ছে। এতে ওই এলাকার শত শত বিঘা আবাদী জমি নষ্ট হওয়ায়, শতাধিক ভুক্তভুগী পরিবার জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। যেখানে রয়েছে হতদরিদ্র ১৭ টির মত আদিবাসী গারো পরিবারও। ফলে খাল খনন যেন ওইসব কৃষক পরিবারের এখন গলার কাটা হয়ে পড়েছে।
ইতিমধ্যে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী তাড়ানি এলাকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন নাগরিক সমাজের স্থানীয় (জেলার) ১৫ সদস্যর প্রতিনিধিদল।
এ বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জোবেদা বেগম জানান, আমি কত চেয়ারম্যানের কাছে দৌড়াদৌড়ি করেছি। তাকে অনুরোধ করেছি। ভাই আমার মাত্র পাঁচ কাঠা জমি। আমার স্বামী নাই, আমি বিধবা। আমার পরিবারে দুই মেয়ে আছে। যাদের বিয়ের বয়স হয়েছে। এই জমির ধান দিয়ে সারা বছর আমাদের চাহিদা মেটে। যখন আমার জমিতে বেকু (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়ে খাল খনন শুরু করল। তখন আমি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দুই জনের পায়ে ধরেছি। কান্নাকাটি করেছি। কেউ আমার কথা শুনে নাই, মানে নাই।
নেকজান জানান, আমার এই দুনিয়ায় স্বামী-সংসার কিছু নাই। দীর্ঘদিন ঢাকার বাসা বাড়িতে কাম কইরা কিছু টাকা জমায় ছিলাম। সে টাকা দিয়ে কিছু জমি কিনেছিলাম। এই জমিতে ফসল ফলাইতাম। ফসল বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চালাইতাম। এখন আমার পুরা জমিতে খাল খনন করা হয়েছে। কত মানুষের পায়ে ধরলাম। কেউ আমার কথা শুনল না। আমার কেনা জমিতে তারা খাল খনন করল। অথচ আমারে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ দিলো না।
জমিলা খাতুন জানান বাবা আমার মাত্র ৭ কাঠা জমি। তার মধ্যে ৪ কাঠা জায়গার মধ্যে খাল খনন করা হয়েছে। সম্পূর্ণ জমি আমার ক্রয় করা সম্পত্তি। খাল খননের বিষয়ে আমাকে কেউ কোন নোটিশ দেয় নাই। জোর করে তারা আমার জমিতে খাল খনন করল। এখন সরকারের কাছে আমার দাবি। তারা আমার জমি নিয়েছে, এটির বিষয়ে আমার কোন কথা নাই। আমাকে যেন যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
আদিবাসী পরিবারের সেংরিম মানকিন বলেন, এমনিতে আমরা আদিবাসী কারো সম্প্রদায়। আমাদের জমিজমা কম। এদিকে সব জন্য খাল খননে পড়ে গেছে। এখন পরিবারের সকলকে না খেয়ে মরতে হবে। এ বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান একজন জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের কে কৃষকেরা জনিয়েছিলেন তাদের সেচের জন্য পানি প্রয়োজন। তাই যেন অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি খাল খনন করা হয়। এই খাল খনন বর্তমান সরকারের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ দেখভাল করছেন। আমরা এ পর্যন্ত তিন চার কিলোমিটার খাল খনন করেছি। কেউ কোন প্রকার বাধা প্রদান করেনি। আমরা তো কারো জমি জোরপূর্বক যাই নাই। একটু সমস্যা রয়েছে। এখানে কয়েকটি পরিবারের দাবি মেটালে, খাল খননে অন্যান্য যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদেরকেও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
নারী নেত্রী আইরিন পারভীন জানান, আমরা খাল খনন এলাকা পরিদর্শন করেছি। এখানে সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত। সবাই হাহাকার করছে, কান্নাকাটি করছে। এখানে এমনও পরিবার আছে যাদের পরিবারে কোন পুরুষ অভিভাবক নেই। মায়েরা কষ্ট করে মানুষের বাড়িতে কাজ করে জমিটুকু কিনেছিল। এছাড়াও যেখানে খাল খনন করা হয়েছে। তার ওই পাশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তাই বর্ষা মৌসুমে এখানে পড়ে শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি আছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের নিকট আমরা দাবি জানাই। যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বিষয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ শেরপুর জেলা কমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ জানান, আমরা ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। পরিদর্শনকালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেছি। তাদের সুবিধা, অসুবিধার কথা শুনেছি। যেখানে কোন প্রকার অনুমোদিত নকশা, বাজেট ও পরিকল্পনা ছাড়াই টিআর-কাবিটার টাকায় স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল এই কাজ করছে। তারা তাদের মণগড়া ভাবে উপজেলার কালাকুমা বৈশাখী বাজার থেকে তাড়ানি গ্রামের ভোগাই নদী পর্যন্ত ৬ থেকে ৭ ফুট গভীর এবং ১৫ থেকে ১৬ ফুট প্রশস্ত করে প্রায় ৩ কিলো মিটার খাল খনন করছে।
জনউদ্যোগ আহবায়ক আরো বলেন, স্থানীয় অদিবাসীদের রেকর্ডিয় সম্পত্তির ওপর দিয়ে এ খাল খনন করা হলেও তাদেরকে কোন ধরনের ক্ষতি পূরণ দেওয়া হয়নি। এই খাল খননে অদিবাসীসহ স্থানীয় নিন্ম আয়ের অনেক পরিবার রয়েছে । যাদের এখানকার ফসল বিক্রির টাকায় সংসারের খরচ চলে। এঘটনায় এই এলাকার অন্তত ১৩টি আদিবাসী গারো পরিবারসহ নিন্মআয়ের শতাধিক পরিবার ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাই ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জোরপূর্বক খাল খননের ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবী জানাই।
এবিষয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পি আই ও) আব্দুল হান্নানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি অফিসের বাইরে। অফিসে থাকলে হয়তো খাল খননের বিষয়ে সঠিক তথ্যটা আপনাকে জানাতে পারতাম। আমি আপনাকে আধঘন্টা পর তথ্যটি জানাচ্ছি। এরপর ৩০ মিনিট পর তার সাথে যোগাযোগ করা হলে উনার ব্যবহৃত নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, আমি এবিষয়ে অবগত ছিলাম না। খাল খননের পর কয়েকজন লিখিত অভিযোগ করার পর বিষয়টি জেনেছি। ইতিমধ্যে একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে আসলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।