শেরপুরে ৬৪টি ইট ভাটার মধ্যে ৬১টি অনুমোদনহীন ! পরিবেশ বিপর্যস্ত

স্টাফ রিপোর্টার
মঙ্গল, 11.10.2022 - 08:28 PM
Share icon
Image

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই শেরপুরে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ ইটভাটা। এ অবৈধ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে বনের কাঠ পুরানোর অভিযোগও অনেক পুরাতন। ফলে ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। আর অধিকাংশ ইটভাটাই পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম না মেনে লোকালয়ের ১০০ মিটার থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়সহ হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় অবৈধ এসব ইটভাটা বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন শেরপুর পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আল মাহমুদ।

পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের নীরবতা ও নিশক্রিয়তার মুখে শ্রীবরদী উপজেলার কুড়িকাহনিয়া ইউনিয়নে ২০১৯ সালে চালু হয় পরিবেশ বিধ্বংসী আরও একটি ইটভাটা। এনিয়ে শ্রীবরদী উপজেলায় অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা ১৬ পেরিয়ে গেল। এসব ইটভাটার নির্গত কালো ধোয়ায় চরম হুমকির মুখে পড়েছে ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামের সবুজ শ্যামল ধান ক্ষেত। ইটভাটায় জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহারের ফলে জমি হারাচ্ছে তার উর্বরতা। যার প্রভাব পড়ছে কৃষি উৎপাদনে।

সরেজমিনে উপজেলার কুড়িকাহনিয়া ইউনিয়নের ইন্দিলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অবৈধ এই ইটভাটার ২২০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত তেজার কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত ইন্দিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইন্দিলপুর আব্দুল মজিদ উচ্চ বিদ্যালয়, ৬০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত ইন্দিলপুর বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত ইন্দিলপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং ইটভাটার সিমানা প্রাচিরের সাথেই লাগানো তেজার কান্দি সেকান্দর আলী কওমি মাদ্রাসা। এছাড়াও এসব জনবসতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশ ঘিরে রয়েছে বিস্তীর্ণ কৃষি জমি। এতে চরম ভাবে হুমকির মুখে শিশু শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা।

পরিবেশ রক্ষায় ইট ভাটাটি বন্ধ করতে স্থানীয় জনগণের পক্ষে মেহেদী হাসান মিলন নামের জনৈক ব্যক্তি পরিবেশ অধিদফতরের ময়মনসিংহ বিভাগীয় কর্মকর্তার দপ্তরে লিখিত আবেদন করেও কোন লাভ হয়নি জানিয়ে বলেন, অবৈধ ইট ভাটাটি স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় চালু করা হয়। চালুর পর থেকেই পরিবেশের ক্ষতি করে চললেও মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে কয়েক ধাপে। সর্বপ্রথম ইট ভাটার নাম ছিলো মেসার্স আফসিন ঝিকঝাক অটো ব্রিকস যার স্বত্বাধিকারী ছিলো মো. হাবিবুর রহমান, পরবর্তীতে ইটভাটার মালিকানা পরিবর্তন করে মেসার্স জেডিএস নাম ধারণ করে যার স্বত্বাধিকারী আনোয়ারুজ্জামান। সর্বশেষ ফারুক আহমেদের নতুন মালিকানায় চলছে মেসার্স ফাতেমা ঝিকঝাক অটো ব্রিকস। এ বিষয়ে মেসার্স ফাতেমা ঝিকঝাক অটো ব্রিকস এর মালিক ফারুক আহমেদ বলেন, জেলায় হাতে গুনা ২/৩ টা ভাটা ছাড়া আর সবাই নিবন্ধন বিহীন ভাবেই চালাচ্ছে‌। সবাই যেভাবে চালায় আমিও সেভাবেই চালাবো। এ ছাড়াও তিনি বলেন, আমি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছি।

অনুমোদন বিহীন ইট ভাটা কিভাবে চলছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর পরিবেশ অধিপ্তরের সহকারি-পরিচালক আল মাহমুদ বলেন, বিষয়টি আমরা অবগত আছি। তারা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলো কিন্তু ইটভাটা স্থাপন আইনে এই প্রতিষ্ঠান করার মতো পরিবেশ না থাকায় আমরা তাদের ছাড়পত্র প্রদান করিনি। তবে আমরা স্পেশাল মেজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করবো। পরবর্তিতে আদালতের নির্দেশে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ভাটার পার্শ্ববর্তী ইন্দিলপুর আব্দুল মজিদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর হোসেন বলেন, জনবসতি পূর্ণ এলাকায় ইটভাটা করার অনুমতি স্থানীয় প্রশাসন কিভাবে দিয়েছে আমাদের বোধগম্য নয়। ইটভাটার কারণে বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন হাঁপানি, এলার্জি, সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন রোগে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে এই ভাটা অপসারণ দাবি করছি।

স্থানীয় বাসিন্দা জিয়াউর রহমান জানান, আমাদের বাড়ি থেকে অল্পকিছু দূরেই এই ইটভাটা অবস্থিত। এই ভাটার ধোঁয়ার কারণে গ্রামের আম, জাম ও নারকেল গাছসহ সব ধরনের ফলের গাছের ফলন কমে গেছে। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। উক্ত ইট ভাটাটি দীর্ঘদিন যাবৎ প্রস্তুত ও ইট ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩ সংশোধিত ২০১৯ অমান্য করে এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষণ করে পরিচালিত হচ্ছে। কৃষি জমি নষ্ট করে অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে বিধায় কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। ইট ভাটাটিতে অবৈধভাবে ইট পোড়ানোর জন্য কৃষি জমির টপ সয়েল (জমির উপরের অংশ) থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। তাছাড়া ভাটা সংলগ্ন চিথলিয়া, পূর্ব ঝিনিয়া, কারার পাড়া সহ ইন্দিলপুরের ৪টি গ্রামের বাসিন্দারা ইটভাটা থেকে সৃষ্ট কালো ধোয়ার দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সিভিল সার্জন ডা. অনুপম ভট্টাচার্য্য বলেন, ইদানীং যত্রতত্র তৈরি করা হচ্ছে ইটভাটা। এমনকি আবাসিক এলাকার মধ্যে একেবারে শহরের কাছেই গড়ে উঠছে এসব ভাটা। এতে ভাটার যে কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে তাতে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক আকারে প্রভাব পরছে। এই কালো ধোঁয়ার মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মন অক্সাইডসহ আরও ক্ষতিকর যে সমস্ত পদার্থগুলো রয়েছে তা মানুষের শরীরের মধ্যে ঢুকে বিভিন্ন ধরনের রোগের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের মধ্যে প্রবেশ করে অনেক ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার 

মো. ইফতেখার ইউনুস বলেন, আমি সদ্য যোগদান করার এই ইটভাটার ব্যাপারে বিস্তারিত জানিনা। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের ব্যাপারে তদন্ত পূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য, শেরপুর পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য মতে জেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ৬৪টি। এগুলো মধ্যে শেরপুর সদর উপজেলায় ৩৫টি, শ্রীবরদী উপজেলায় ১৭ টি, ঝিনাইগাতী উপজেলায় ১টি, নালিতাবাড়ি উপজেলায় ২টি এবং নকলা উপজেলায় ৯টি। তার মধ্যে নিবন্ধিত ইটভাটার সংখ্যা মাত্র ৩টি। তবে আইন না মানায় ইতোমধ্যেই ৪টি প্রতিষ্ঠানকে গুড়িয়ে দিয়া হয়েছে।

Share icon