মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সরকার যেভাবে কাজে লাগাতে পারে
রফিক আহমদ খান, মালয়েশিয়া প্রবাসী সাংবাদিক :
গণমাধ্যমের খবরে জানলাম, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি পাঠাতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাড়তি সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আমার কাছে এটা যেনো চোর পালিয়ে যাওয়ার পর চোর চোর করে চিল্লানোর মত। দিনের আলোতে চোখের সামনে চোরে চুরি করছে, তখন চোর ধরিনি; পালিয়ে যাওয়ার পর 'চুরি হয়ে গেছে', 'চুরি হয়ে গেছে' বলে গলা ফাটানো!
এখন কেনো এই অভিযোগ! বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশীয় নাগরিক মোহাম্মদ আমিন বিন আবদুন নূর এর মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান 'সিনারফ্ল্যাক্স' ও বাংলাদেশের ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক (রিক্রুটিং এজেন্সি) একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ‘জি টু জি প্লাস’পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরুর বহু আগে থেকে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কত লেখালেখি-ই তো হলো। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব পত্রিকায় এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বড় বড় রিপোর্ট দেখেছি তখন।
মালয়েশিয়ায় এখনো প্রচুরসংখ্যক বিদেশি শ্রমিকের চাহিদা আছে ; এবং চাহিদা আছে বাংলাদেশি কর্মীর। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর সব রকম প্রচেষ্টা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অব্যাহত রাখতে হবে। কোনো কারণে যেনো বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ না হয়। যে কোনো প্রচেষ্টায় ধরে রাখতে হবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার
২০১৬ সালের পত্রপত্রিকায় খুঁজলে এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি পাওয়া যাবে। কিন্তু, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠানো লোকে দেওয়া যায়নি তখন! এই সিন্ডিকেটকে তখন ভাঙতে না-পারার অন্যতম কারণ ছিলো তৎকালীন মালয়েশিয়ান সরকারের সমর্থন ছিলো সিন্ডিকেটের প্রতি। সিনারফ্ল্যাক্সের সাথে জড়িত ছিলো নাজিব রাজ্জাক সরকারের প্রভাবশালীরা। আর সিনারফ্ল্যাক্সের পছন্দে গঠিত হয়েছিলো বাংলাদেশের ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক (রিক্রুটিং এজেন্সি) প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সিন্ডিকেট মুক্ত করার জন্য মালয়েশিয়ায় প্রবাসী ব্যবসায়ীরা বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী এমপি'র কাছে দাবি জানিয়েছিলেন। মৌখিক দাবির পাশাপাশি লিখিত দাবিও করেছিলো প্রবাসীরা। এ নিয়ে একাদিক প্রতিবাদ সভাও করেছিলেন প্রবাসী ব্যবসায়ীরা। তারপরও তখন সিন্ডিকেট মুক্ত হয়নি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
অনেকের ধারণা তখনকার মালয়েশিয়ান সরকারের কারণে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। বছর খানেক আগে দায়িত্ববান এক আমলার সাথে এই বিষয় নিয়ে আলাপকালে তিনি বলেছিলেন, " সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে যাঁরা মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে তাঁরা ঠিক মত কাজ করছে কিনা, কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে কিনা সে দিকে"। হ্যাঁ, এখানে সরকার অনেকটা সফল বলা যায়। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় যাওয়া লোকদের তেমন অভিযোগ পত্রপত্রিকায় আসেনি। শুধু শেষ দিকে পোর্ট ক্লাং এলাকায় একটি ফ্যাক্টরিতে যাওয়া কর্মীদের নানা অভিযোগের কথা গণমাধ্যমে এসেছে।
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যাওয়া লোকদের তিন থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই অতিরিক্ত অভিবাসন খরচের কথা এখন কেনো বলা হচ্ছে? যখন এই পরিমাণ টাকা খরচ করে কর্মী মালয়েশিয়া যাচ্ছে তখন তো একাদিক মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে; কর্তৃপক্ষ তখন বিষয়টা দেখেনি কেনো?
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাড়তি সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অনুসন্ধানে করে হয়ত সিন্ডিকেটের দশ রিক্রুটিং এজেন্সিকে বিচারের আওতায় আনতে পারবে। কিন্তু, যাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে তাদের টাকা তো আর ফেরত দেওয়া যাবে না, বা ফেরত দেওয়া হবে না। তাহলে মালয়েশিয়া যাওয়া কর্মীদের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। যা আর পূরণ করার নয়।
ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে দুদক অনুসন্ধান আর তদন্ত যা করার করুক। সরকারের উচিত হবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ধরে রাখার জন্য কাজ করা। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সভাপতিত্বে গত ১৪ আগস্ট বিদেশি শ্রমিক সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির এক বৈঠকে বিদ্যমান পদ্ধতিতে (সিন্ডিকেটের মাধ্যমে) বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া স্থগিত ঘোষণা করা হয়। যা ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হচ্ছে। এই ঘোষণার পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে মর্মে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
এই প্রেক্ষিতে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাই কমিশনের লেবার কাউন্সিল থেকে পাঠানো একটি বার্তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। লেবার কাউন্সিল জানালেন, " মালয়েশিয়া চলমান পদ্ধতি বাতিল করেছে, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ ঘোষণা করেনি"। এটা যদি হয় তাহলে বাংলাদেশের জন্য ভালো-ই হলো। সিন্ডিকেট মুক্ত হবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
মালয়েশিয়ায় এখনো প্রচুরসংখ্যক বিদেশি শ্রমিকের চাহিদা আছে ; এবং চাহিদা আছে বাংলাদেশি কর্মীর। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর সব রকম প্রচেষ্টা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অব্যাহত রাখতে হবে। কোনো কারণে যেনো বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ না হয়। যে কোনো প্রচেষ্টায় ধরে রাখতে হবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
বৈধ পথে কর্মী যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে অবৈধভাবে কর্মী যাওয়ার হার অধিক বেড়ে যাবে। তখন সে দেশে বাংলাদেশি বৈধ-অবৈধ সকল কর্মীদের দুর্দশা বেড়ে যাবে।
লেখক : মালয়েশিয়া প্রবাসী সাংবাদিক।