করোনা আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে ফেসবুক লাইভে হুইপ কন্যা ডা. অমির কিছু কথা॥
জাতীয় সংসদের হুইপ, শেরপুর-১আসনের এমপি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিউর রহমান আতিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে পরবর্তীতে তিনি সুস্থ হন। করোনা কালীন সময়ে তার কন্যা ডা.শারমিন রহমান অমি বাবাকে খুব কাছে থেকে সেবা করেছেন। পাশে থেকে সেবা করার পরও তিনি করোনা আক্রান্ত হয়নি। খুব কাছে থেকে করোনায় আক্রান্ত রুগীকে কিভাবে সেবা করা যায়, সেই অভিজ্ঞতাকে তার ফেসবুক লাইভে এসে বিস্তারিত বলেছেন। তিনি এ বিষয়ে নিয়ে যা বলেছেন তা হুবুহ তুলে ধরা হলো........
ডা.শারমিন রহমান অমিঃ আমি আপনাদের সামনে এসেছি আমার বাবা জাতীয় সংসদের হুইপ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আতিউর রহমান আতিক এমপি উনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলো আমি ঐ সময়ের কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। আমি আশা করছি আমার এই অভিজ্ঞতা দ্বারা আপনারা অনেকেই উপক্রিত হবেন। প্রথমেই আল্লাহ তাআলার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহোদয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়, মাননীয় স্পিকার মহোদয় এবং চীফ হুইপ মহোদয় ও অন্যন্য সংসদ সদস্যবৃন্দ মহোদয়দের যারা প্রতিটা মূহুর্তে আমাদের পাশে থেকে সবসময় খোজ খবর নিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছেন এবং আমার আব্বুর চিকিৎসায় যেন কোন ক্রুটি না হয় এই জন্য সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন এবং ধন্যবাদ জানাই আমাদের শেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দদের ও শেরপুরের সর্বস্তরের জনগনদের যারা আমার আব্বুর জন্য দোয়া মাহফিল করেছেন। অনেকেই আছে যারা রোজা রেখেছে সবাইকে আমি আবারও কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আরও ধন্যবাদ জানাই বিভিন্ন স্কুল কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের যারা আমার বাবার জন্য দোয়া করেছেন।
আমার আব্বু বলেছেন আমরা শেরপুর বাসিসহ সকলের কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। আপনারা আমাদের যে ভালোবাসা দিয়েছেন তার ঋন কখনো পরিশোধ করতে পারবো না। আমরা আপনাদের পাশে আছি এবং থাকবো। আপনাদের পাশে থেকে সবসময় আপনাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করবো। আপনারা যেমন আমার বাবাকে ভালোবাসেন তেমনি আমার বাবাও শেরপুর বাসিকে প্রচন্ড ভালোবাসেন।
আমার বাবা কিভাবে কোভিড ১৯ দ্বারা আক্রান্ত হলো সে বিষয়গুলো আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো, যেহেতু প্রত্যেকটা দিন আমি ছায়ার মতো আব্বুর পাশে ছিলাম। প্রথমেই আমার আব্বু শেরপুর থেকে ২২ তারিখে ঢাকায় যান। পরে উনার হালকা জ্বর ও কাশি হয়। যেহেতু আমি ডাক্তার আব্বু আমায় বললো আমি কি ঔষধ খাব? কাশিটা একটু বেশি মনে হচ্ছে। আমি বললাম যেহেতু হালকা জ্বর তুমি একটা নাপা খাও, আব্বু আমায় বললো এন্টিহিস্টামিন খাই? তো আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে। উনি এন্টিহিস্টামিন শুরু করলো। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের সাথে উনার দেখা করার কথা ছিলো, উনি আমায় বললেন জ্বর একটু কমে গেছে আমি যেহেতু বঙ্গভবনে যাবো তো যাওয়ার আগে করোনা টেস্ট দিতে হয়। আমি আব্বুকে বললাম যেহেতু ২-৩ দিন হয়ে গেছে তুমি টেস্ট করাও। পরে তিনি বৃহস্পতিবার বিকেলে সংসদের পার্লমেন্ট মেম্বারের যে হাসপাতাল রয়েছে সেখানে টেষ্ট করাতে দিলেন। টেস্ট দেওয়ার পর শুক্রবার সকালে আমার আব্বুর পিএস আমাদের ওয়ারেছ আংকেল, উনি আমায় ফোন দিয়ে বললো আম্মু স্যারকে ফোনে পাচ্ছি না। স্যারের তো করোনা পজেটিভ এসেছে। এটা বলার পর আমি কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম। কারণ করোনা রোগটা বয়স্ক ও শিশুদের জন্য রিক্স। আমিও আব্বুকে ফোন দিচ্ছি কিন্তু ফোনে পাচ্ছি না। উনি তখন ঘুমিয়েছিলেন তো আমি কাজের লোকের কাছে ফোন দিয়ে বললাম আব্বুর কাছে গিয়ে আমার ফোনটা ধরিয়ে দাও। আমি আব্বুর সাথে একটু কথা বলবো, তখন উনি নিয়ে গেলেন। আমি আব্বুকে বললাম তুমি উঠে খাওয়া-দাওয়া করো, তোমার শরীর এখন কেমন ? উনি বললো ভালো, আমি বললাম আব্বু তোমার করোনা পজেটিভ আসছে, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই, করোনার যে মেডিসিন ঐগুলো চালু করা দরকার, আব্বু ঠিক আছে বলে ফোনটা রেখে দিলো। রেখে দেওয়ার পর উনার ফোন কখনো বন্ধ পাচ্ছি কখনো বা ধরছে না পরে আমি কাজের লোককে আবার ফোন দিয়ে বললাম আব্বুকে ফোনটা দাও।
এখন পর্যন্ত এই রোগের কোন চিকিৎসা না থাকায় আমরাসহ উনি হতাশ হয়ে পরেন। আমি ডাক্তার হিসেবে অনেক করোনা রোগি দেখেছি কিন্তু নিজের পরিবারের কাউকে এই ভাবে দেখবো, আমি ভাবতে পারিনি।
আমি চেস্টা করলাম যে পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে নিজের মনোবলটা শক্ত রাখতে হবে। আমার এবং আমাদের কারও ফোন বাবা রিসিভ করছেন না। ওখান খেকে আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হলো যে বাবা কারও সাথে কথাও বলছেন না এবং ঠিক মতো খাচ্ছেনও না।
আমার ২২ মাসের একটি বাবু আছে তো ও যখন ঘুমিয়ে পরলো আমি আম্মুকে বললাম আমার আব্বুর চিন্তায় ভালো লাগছে না রাতে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় কিনা অক্সিজেন ফল্ করে কিনা আমার এই মুহুর্তে আব্বুর পাশে থাকা আমার জরুরী। বেশি কিছু না ভেবেই ড্রাইভারকে ডেকে এনে এক কাপড়েই রাত সারে এগারোটায় ঢাকার উদেশ্য রওনা হলাম। ডা. আসাদ ভাইকে আমার সাথে নিয়ে গেলাম। কারণ বাবার এই অবস্থা দেখে আমি যদি ঠিক না থাকতে পারি এই জন্য আমি উনাকে সাথে নিয়ে যাই। তখন রাত ৩ টা বাজে আমি বাবার কাছে পৌছালাম গিয়ে দেখলাম বাবা শুয়ে আছেন। আমি আব্বুকে ডাক দিলাম আব্বু তোমার এখন কি অবস্থা এই বলে অক্সিজেনটা মনিটর করলাম। প্রেশারটা দেখলাম তখন জ্বর ছিলো। মাত্রাছিল ৯৯ ডিগ্রি এর মতো। আর প্রেশারটা ছিলো একটু বেশি। অক্সিজেন সিসোয়েশনটা ভালো ছিল।
যেহেতু আমার বাবা করোনা রোগী তাই আমার ছোট বাবুকে বাড়িতে রেখে গিয়েছিলাম। আমি সম্পূর্ন প্রটেকশন নিয়ে আব্বুর কাছে গেলাম। গিয়ে দেখলাম আব্বুর চোখের কান্না ছলছল করছে। আব্বু ভাবছিল আমার মেয়ে অথচ কত প্রট্রেকশন নিয়ে আজ আমার কাছে এসেছে। আমি বুঝতে পারলাম পরে আমার মূখে যে ফেসশিল ছিলো সেটা খুলে ফেললাম। কারণ বাবার মনবল ঠিক না থাকলে উনি সুস্থ হবেন না। তো মাক্স আর গ্লাফস্ পরে বাবার কাছে গিয়ে বললাম আব্বু আমরা আছি ২-৩ জন ডাক্তার আছে আমরা পাশের রুমেই আছি তুমি ঘুমাও। আমরা সারাক্ষণ তোমাকে দেখবো তুমি নিশ্চিতে ঘুমাও। তখন দেখলাম আব্বুর মনোবলটা একটু ফিরে পেল। উনি ঘুমিয়ে পরল আমি একটু পরপর উনার খোজ খবর নিলাম।
পরে সকালে মাননীয় স্পীকার ও চিফ হুইপ মহোদয় উনারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পি এস আংকেলের মাধ্যমে আমাকে মেসেজ পাঠালো যে । যদি প্রয়োজন হয় তাহলে হসপিটালাইজ করার জন্য। যেহেতু ন্যাম ভবনে বাবার পাশে আর কেউ নেই। আমাদের সম্পূর্ন পরিবার তো শেরপুরে আব্বু একা তাই ভাবলাম হাসপাতালেই থাকাটা সেফ। যদিও আব্বুর কোন অক্সিজেনের প্রয়োজন ছিলনা।
আমি পরের দিন দুপুরে আব্বুকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর চিকিৎসক করোনার ইনজেকশন গুলো আব্বুকে দেয়া শুরু করেন। পরে আমি ডাক্তরের সাথে কথা বলে আব্বুর সকল টেস্ট করালাম। উনার জন্য ব্যাস্ত থাকার কারনে আমি খুবই পিপাসার্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলাম।
যেহেতু আমার আব্বু করোনা রোগী তাই ওখান থেকে পানি খাওয়ার সাহসটাও হচ্ছিলোনা আমার। আমার ছোট একটি সন্তান আছে সেকারনে নিজে একটু সাবধানে থাকার চেস্টা করেছি। আমি ডাক্তরের সাথে কথা বললাম আমার বাড়িতে বাবু আছে সেও কান্না করছে আমি আজ গিয়ে কাল আবার চলে আসবো॥ আব্বুকে রাতের ঔষধ খায়িয়ে ঘুম পারিয়ে আমি করোনা সেম্বলটা পরীক্ষার জন্য দিয়ে ইমারজেন্সী রির্পোট দিবেন বলে আমি বাসায় আসি।
পরে আবার রাত ১১-১২ টার দিকে আমি শেরপুরের উদ্যেশ্য রওনা হই। রাত ৩ টায় আমি শেরপুরের বাসায় এসে পৌচেছি এসে দেখলাম বাবু ঘুমিয়ে পরেছে। আমার মা বাবুকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। আমি বাবুকে দূর থেকে দেখলাম কিন্তু কাছে গিয়ে ধরতে পারছিনা । আমি আম্মুকে বললাম তোমরা কেউ আমার কাছে এসো না যতটুকু সম্ভব দূরে থাকো। আমি গরম পানি দিয়ে গোসল করে একটা রুমে একা দরজা বন্ধ করে দিলাম। পরে আমি মডার্ন হাসপাতালে ফোন দিয়ে আমার করোনা টেস্ট রিপোর্টটার খবর জানতে চাই। আমি বাবুর কাছে যেতে পারছিনা উনারা বললো সকালের দিকে রির্পোট পাবেন। সকাল হলো ঘুম থেকে উঠে বাবুর কান্না শুনছি কিন্ত কথাও বলেতে পারছিনা কাছেও যেতে পারছি না।
সকাল ৯ টার দিকে জানানো হলো যে আমার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ। ইতখন আমি দৌড়িয়ে গিয়ে বাচ্চাকে ধরেছি পরে বাবুকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে আব্বুর খোজ খবর নিলাম। পরে অফিসে কিছু কাজ ছিলো সেগুলো শেষ করে আবারো ঢাকার ঊদেশ্য রওনা হই। এখানে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন বাবার সংস্পর্শে থেকেও এমনকি করোনা ওয়ার্ড এ থেকেও আমার করোনা হলোনা। আমি বিস্তারিত আপনাদেরকে জানালাম আমার দায়িত্ববোধ থেকে।
পরিশেষে তার পরিবারের জন্য দেশবাসীসহ মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দোয়া চেয়ে তিনি ফেইসবুক লাইভের বক্তব্য শেষ করেন।