শেরপুরে বেদখল হচ্ছে বনভূমি, বাড়ছে হাতী মানুষের দ্বন্ধ

ঝিনাইগাতী প্রতিনিধি
শনি, 22.01.2022 - 01:29 PM
Share icon
Image

শেরপুরের গারো পাহাড়ের বনভূমি দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে । এককালে যেখানে গভীর অরণ্যছিল এখন সেখানে বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। গভীর অরণ্য এখন জনবস্তি। বনবিভাগের শতশত একর পাহাড়ি জমিতে এখন চাষাবাদ হচ্ছে। বেদখল হয়ে যাচ্ছে শতশত একর বনভূমি। ফলে বিরূপ প্রভাবে সেই গারো পাহাড়ে এখন বন্যহাতির বিচরণক্ষেত্র বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। অভয়ারণ্য না থাকায় ক্ষুুধার্ত বন্যহাতির দল খাদ্যের সন্ধানে নেমে আসছে লোকালয়ে। সাবাড় করে চলেছে কৃষকের কষ্টার্জিত ক্ষেতের ফসল ও গাছপালা। এতে যেন পাল্লা দিয়েই বাড়ছে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব।

বন্য হাতির তান্ডবে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে কৃষকদের জানমাল ও ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বন্যহাতির দল দিনের বেলায় গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিচ্ছে। আর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নেমে আসছে লোকালয়ে।

তবে ক্ষেতের ধান পেকে উঠার সাথে সাথে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বন্য হাতির পদচারণা বেড়ে যায়। এসময় ক্ষেতের ফসল ও কৃষকদের জানমাল রক্ষার্থে পাহাড়ি গ্রামবাসিরা ঢাকঢোল ও পটক ফুটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কিন্ত যতই হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চলছে ততই বন্যহাতির দল তেড়ে আসছে লোকালয়ে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীর্ঘ দুই যুগে হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নারী পুরুষ ও শিশুসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অর্ধশতাধিক মানুষ। আহত হয়েছেন কয়েক শত। এছাড়া মানুষের পাতা ফাঁদসহ নানাভাবে ৩১টি হাতির ও মৃত্যু হয়েছে। হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য ও প্রাণীরক্ষা। কিন্তু ওই ভয়াবহ অবস্থার দীর্ঘদিন পরও হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে গ্রহণ করা হয়নি কার্যকর ও টেকসই কোন উদ্যোগ বা ব্যবস্থা। এদিকে গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসন এবং বন্যহাতি হত্যার প্রতিবাদ, হাতির জন্য অভয়াশ্রম এবং বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার দাবিতে মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানিয়েছে শেরপুরের নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা আইইডি, ওই দুই সংগঠন থেকে বলা হয়েছে ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শেরপুরের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বন্যহাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেছেন ৫৮জন। আর মানুষের হাতে ৩১টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এসব মৃত্যু হাতির বেশির ভাগই মৃত্যু হয়েছে বৈদ্যুতিক ফাঁদে, গুলিবিদ্ধ হয়ে, নয়তো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। সামাজিক সংগঠনের নেতারা বলেছেন, অভয়ারণ্য গড়ে তুলে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পরেছে।

জানা যায়, ভারতের সীমানাঘেঁষা শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ৩৫টি গ্রাম রয়েছে। প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বনবিভাগের জমি রয়েছে ২০ হাজার একর। এসব পাহাড়ি গ্রামগুলোর চারপাশে গারো পাহাড়। শতাধিক বন্যহাতি কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে ওইসব পাহাড়ী জনপদে বিচরণ করছে। বনের জমি দখল করে অবৈধভাবে চাষাবাদ করায় মানুষ -হাতি দ্বন্দ্ব বেড়ে গেছে। এখানে বনের প্রায় ২ হাজার একর জমি অবৈধ দখলদারের হাতে বেদখল হয়েছে। বনবিভাগ বলেছে অবৈধ দখলদারও বেদখলীয় জমির তালিকা প্রনয়নের কাজ চলছে। বনের জমি বেদখল ও পাহাড় সংকুচিত হয়ে আসায় এসব পাহাড়ি গ্রামগুলোতে উপুর্যুপুরি বন্য হাতির তান্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে পরেছে পাহাড়ি গ্রামবাসীরা।

কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে, বন্য হাতির পদচারনা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাহাড়ি এলাকাব কৃষকদের শতাধিক একর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে না। অনাবাদি হয়ে পরে আছে এসব জমি।

শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক মোঃ আবু ইউসুফ বলেন, হাতি অত্যন্ত নিরীহ প্রাণী। আমরা চেষ্টা করছি যাতে হাতির কোন ক্ষতি না হয়। হাতিকে মেরে ফেললে আমরা কোন ছাড় দেব না। তবে মানুষের জানমালেরও যেন কোন ক্ষতি না হয়, সেদিকেও সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, মানুষ -হাতি দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে। এছাড়া, হাতি মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে গারো পাহাড়ে অভয়াশ্রম গড়ে তোলার পরিকল্পনা ও হাতে নেয়া হয়েছে। এজন্য তিনি প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেন।

জেলা প্রশাসক মোঃ মোমিনুর রশীদ বলেন, সীমান্তের গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমরা বন্যহাতির হামলায় নিহত, আহত ও ঘরবাড়িসহ ফসল ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি পাহাড়ে হাতিসহ প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় চেষ্টা করছি। তবে স্থায়ী সমাধানে অভয়ারণ্য গড়ে তোলাসহ টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে ।

Share icon