শেরপুরের শাল ও গজারি বনে জ্বলছে আগুন, বিপর্যস্ত প্রকৃতি, উজাড় হচ্ছে গাছ
শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতি, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ি উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় গত কয়েক বছর ধরেই শুষ্ক মৌসুমে বনের বিভিন্ন অংশে আগুন দিচ্ছে একটি অসাধু চক্র। এতে পুড়ছে গাছের চারা, নষ্ট হচ্ছে বড় গাছ, বিপন্ন হচ্ছে পাখিসহ উপকারী কীটপতঙ্গ। বনবিভাগ যখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত সেই সুযোগে বনের মূল্যবান গাছ কেটে বন উজাড় করছে চক্রটি।
শাল বাগানের জন্য সুখ্যাতি আছে শেরপুরের সীমান্তবর্তী এই তিন উপজেলার বনের। এখানকার বিস্তৃর্ণ বনভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র ও অভয়ারণ্য। কিন্তু পুরনো এই বাগান ধ্বংস করে লাগানো হচ্ছে ইউক্যালিপটাস-আকাশমনিসহ পরিবেশ বিরোধী গাছের চারা। এসব চারা লাগাতে মৌসুমে আগুন দেয়া হয় শুস্ক বনভূমিতে। এতে মরে যাচ্ছে অনেক বড় গাছ। সেই গাছ রাতারাতি কেটেও নিচ্ছে একটি চক্র।
স্থানীয় অধিবাসী ও বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে পাওয়া গেছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। পাহাড়ি অধ্যুষিত আদিবাসী দের সাথে কথা বলে জানা যায় শুষ্ক মৌসুমে গাছ থেকে ঝরে পড়ে পাতাতে পর্যটকরা ঘুরতে এসে এখানে আগুন দেয় এতে শুরু হয় আগুনের সূত্রপাত। অপরদিকে বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন স্থানীয় অধিবাসীরা এই কাজের সাথে জড়িত।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে ঘুরতে আসা মো. আব্দুল জব্বারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, শেরপুর জেলার পাহাড়ি এলাকার পরিবেশ মনমুগ্ধকর হওয়ায় আমরা এখানে ঘুরতে আসি। আমরা সব সময় চাই এখানের প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় থাকুক। আগুনের ব্যাপারে তারা বলেন, পর্যটকরা এখানের পরিবেশ উপভোগ করতে আসেন। সুতরাং তারা বনে আগুন লাগাবে এই কথাটা ভাবাই হাস্যকর। তবে তিনি পর্যটন এলাকা গুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার আহবান করেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও শাল-গজারি বন রক্ষায় কোটি টাকার প্রকল্প আছে। স্থানীয় অধিবাসীদের অভিযোগ, সরকারি গাছ দেখভালের বিনিময়ে টাকা দেয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। এখন সেই গাছই রাতারাতি লুট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানালেন, কথা ছিল শালবন রক্ষা ও দেখভালের জন্য টাকা দিবে। কিন্তু সেই কথা রক্ষা করা হয়নি। ২০ বছর ধরে পরিশ্রম করছি আমরা, কিন্তু কেউ কখনও এক টাকাও দেয়নি। এছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কৃষক বলেন, সমতলের পাহাড় গুলো সবুজ ঘাসে বেষ্টিত থাকায় ধানের পাশাপাশি আমরা গরু লালন পালন করি। বনের হাজার হাজার হেক্টর জমি আগুনে পুড়ে উজাড় হয়ে যাওয়ায় আমাদের গো খাদ্যের সংকট তৈরি হয়েছে। বিচরণভূমি গুলোতে এখন খাঁ খাঁ মরুভূমি অবস্থা বিরাজ করায় গরু লালন পালনে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।
এ ব্যাপারে রাংটিয়া রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মকরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, যে অংশগুলোতে গাছ পুড়ে গেছে সেগুলো পুনরায় গাছ লাগানো হবে তার মানে রিপেয়ারিং করার সুযোগ আছে। তবে স্থানীয় মানুষরাই এ আগুন লাগাচ্ছে বলে তার অভিযোগ। কেন স্থানীয় মানুষ আগুন লাগাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে সমস্ত অসাধু মানুষ আমাদের নিয়ম-কানুনের বাইরে চলতে পারছে না এবং বন থেকে বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন না তারাই হিংসার বশবর্তী হয়ে এই কাজটি করছেন। এছাড়াও এক সাথে বৃহত্তর এলাকায় আগুন লাগলে বনের সামান্য জনবল নিয়ে আগুন নেভাতে আমরা হিমশিম খাই। এছাড়াও আগুনের ক্ষতিকর দিক বর্ণনা করে এর আগে দুইবার সতর্কতামূলক মাইকিং করা হয়েছে। তবে এই প্রচার-প্রচারণা গুলো আরো বৃহৎ পরিসরে করা দরকার বলেও তিনি স্বীকার করেন।
শাল-গজারি রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য লোকবলের অজুহাত দিয়ে শেরপুর বনবিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক আবু ইউসুফ বলেন, মূল বিষয়টি হলো যে প্রত্যেকটা বিট অফিসে যে পরিমাণ লোকবল আছে তা দিয়ে শালবনের আগুন নেভানো দুঃসাধ্য কাজ। এ ঘটনায় শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশিদ বলেন, বনে আগুন দেয়ার ঘটনা আমি শুনেছি। জেলা বনবিভাগের অফিসারদের সাথে কথা বলে তাদের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।